প্রযোজকদের এবার ঈদের ছবির হিসাব-নিকাশ করতে একটু হিমশিম খেতে হচ্ছে। কারণ, বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসর যে ঈদ উৎসবের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার গেছে। তারপরও দেশের চলচ্চিত্রপ্রেমী দর্শকদের কথা ভেবে প্রযোজকেরা সাহস করে ছবি মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান আর বুকিং এজেন্টদের সঙ্গে কথা বলে তেমনটাই জানা গেছে।
আজ বুধবার দুপুর পর্যন্ত যে তিনটি ছবি মুক্তির ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে, সেই ছবি তিনটি হলো উত্তম আকাশের ‘চিটাগাংইয়া পোয়া নোয়াখাইল্লা মাইয়া’, রায়হান রাফীর ‘পোড়ামন ২’ এবং আবদুল মান্নানের ‘পাঙ্কু জামাই’। এবার ঈদে ‘সুপারহিরো’ ছবিটি মুক্তির চেষ্টা করা হলেও আজ পর্যন্ত ফিফটি-ফিফটি চান্স রয়ে গেছে। ‘সুপারহিরো’ ছবির মুক্তির ব্যাপারে আজ দুপুর পর্যন্তও কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারেননি পরিচালক আশিকুর রহমানও। এবার ঈদের ছবির নায়ক-নায়িকারা হলেন শাকিব খান, বুবলী, অপু বিশ্বাস, সিয়াম, পূজা চেরী প্রমুখ।
ঈদের তিনটি ছবির মধ্যে কোনটি কটি প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শনের ব্যাপারে চূড়ান্ত হয়েছে, তা পুরোপুরি নিশ্চিত হতে আর দুদিন সময় লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র বুকিং এজেন্ট সমিতির সভাপতি সারোয়ার দিপু।
এবারের ঈদের ২২ টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাচ্ছে জাজ মাল্টিমিডিয়া প্রযোজিত ছবি ‘পোড়ামন ২’। ঢাকা স্টার সিনেপ্লেক্স, যমুনা ব্লকবাস্টার, শ্যামলী সিনেপ্লেক্সসহ বিভাগীয় শহরগুলোর অভিজাত প্রেক্ষাগৃহগুলো এই ছবির দখলে আছে বলে বুকিং এজেন্ট সূত্রে জানা গেছে। ‘পোড়ামন ২’ ছবির প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার আবদুল আজিজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের উম্মাদনা যেহেতু অনেক তাই দর্শক কমার সম্ভাবনাটা মোটেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। খানিকটা চিন্তিত হলেও ছবিপ্রেমী দর্শকের কথা চিন্তা করে আমরা প্রেক্ষাগৃহে থাকছি। আর কোনোভাবে ছবি যদি ক্লিক করে, তাহলে খেলার মধ্যেও দর্শক প্রেক্ষাগৃহে যাবেই।’
‘পোড়ামন ২’ ছবিটি ২০১৩ সালে মুক্তি পাওয়া পোড়ামন ছবির সিক্যুয়েল। একই প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে নির্মিত জাকির হোসেন রাজু পরিচালিত ‘পোড়ামন’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন সাইমন ও মাহি।
এবার ঈদে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি প্রেক্ষাগৃহের কর্তৃপক্ষ আগ্রহ দেখিয়েছে শাপলা মিডিয়া প্রযোজিত ‘চিটাগাংইয়া পোয়া নোয়াখাইল্লা মাইয়া’ ছবিটি নিয়ে। এই ছবিতে অভিনয় করেছেন শাকিব খান, বুবলী, মৌসুমী, ওমর সানী প্রমুখ। এরই মধ্যে ছবির ট্রেলার ও গান প্রকাশিত হয়েছে। চলচ্চিত্রপ্রেমী দর্শকদের কাছে ছবির ট্রেলার ও গান প্রশংসিত হয়েছে।
এই ছবির প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার সেলিম খান মোটেও চিন্তিত নন বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে। তিনি বিষয়টিকে ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। বললেন, ‘এটা পুরোটাই ভাগ্যের ব্যাপার। বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে আমি মোটেও চিন্তা করতে চাই না। ছবির গল্প যদি শক্তিশালী হয়, তাহলে এই গল্প দর্শককে প্রেক্ষাগৃহে টেনে নিয়ে যাবেই।’
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া বগুড়ার তরুণ কৌশিক কণ্ডু প্রেক্ষাগৃহে নতুন কোনো ছবি মুক্তির খবর পেলেই বন্ধুদের নিয়ে ছুটে যান। ছবি দেখার পাশাপাশি নিজে ক্রিকেট খেলেন। ফুটবলের প্রতি তাঁর ভালোবাসা তীব্র। ব্রাজিল দলের ভক্ত এই তরুণের কাছে জানতে চাওয়া হয়, বিশ্বকাপ ফুটবল কি ছবির প্রতি দর্শক টানতে বাধা হবে? ‘এবার বিশ্বকাপের বেশির ভাগ খেলা সন্ধ্যা থেকে শুরু হবে। আমরা সবাই যে ছবি দেখি, তারা বিকেল কিংবা সন্ধ্যার শোতে দল বেঁধে যাই। বিশ্বকাপ ফুটবল যেহেতু চার বছর পর আসে, তাই সবাই অধীর আগ্রহে বসে থাকি। এবার ছবি দেখার প্রতি দর্শক আগ্রহ কিছুটা হলেও কম থাকবে,’ বলেছেন কৌশিক কণ্ডু।
সাভারের ব্যবসায়ী এস এম বাশার জানালেন, তিনি ছবি দেখার পোকা। মাঝেমধ্যে কলকাতায় যখন যাওয়া হয়, তখনো সময় সুযোগ বের করে প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে ছবি দেখেন। অনেক বছর ধরে ঈদ উৎসবে ছবি দেখা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে তাঁর। ফুটবলের ভক্ত বাশার বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা দেখা মিস করতে চান না। বললেন, ‘আমার পছন্দের দল জার্মানি। মনেপ্রাণে চাই আমার প্রিয় দলটি যেন বিশ্বকাপে বিজয়ী হয়। তবে আমার পছন্দের খেলোয়াড়দের মধ্যে আছেন মেসি, নেইমার, রোনালদো আর সালাহ। বিশ্বকাপের প্রতিটি খেলা দেখি। বাসায় বন্ধুদের দাওয়াত করে দল বেঁধে খেলা দেখি। ছবির ক্ষেত্রে যদি অসাধারণ গল্পের কিছু না হয়, তাহলে হয়তো খেলা ছেড়ে প্রেক্ষাগৃহে যাওয়া হবে বলে হয় না। তবে যেদিন খেলা থাকবে না, সেদিন শাকিব খান, বুবলী ও নবাগত সিয়ামের ছবি দেখার ইচ্ছে আছে। ইউটিউবে তাঁদের ছবির ট্রেলার দেখেছি।’
‘অন্ধ নিরাঙ্গম’ ও ‘সত্তা’ ছবির নির্মাতা হাসিবুর রেজা কল্লোল কোনো ভণিতা না করে বললেন, বিশ্বকাপ ফুটবল ঈদে মুক্তি পাওয়া ছবির দর্শকে পুরোপুরি ভাগ বসাবে। তিনি বললেন, ‘যে ছবিগুলো মুক্তি পাচ্ছে, তা নিয়ে দর্শকদের তেমন আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না। এটা আমাদের চলচ্চিত্রকে আরেক দফা পিছিয়ে দেবে। তার সঙ্গে বিশ্বকাপের ফুটবলের উন্মাদনা অন্য এক মাত্রা যোগ করবে।’
তরুণ লেখক মাহতাব হোসেন মনে করেন, ‘ঢাকাই চলচ্চিত্রকে বাঁচিয়ে রেখেছে তৃণমূল পর্যায়ের দর্শক। প্রত্যেক অভিনেতা-অভিনেত্রীর ভক্ত আছে। তারা তাদের জায়গা থেকে প্রিয় তারকাদের ছবি দেখবে। পছন্দের দলের খেলার সময় হলের সেই শোডাউন হবে, কিন্তু পরবর্তী সময়ে সেটা পুষিয়ে নেবে। আরও পরিষ্কার করে বললে, বিশ্বকাপজুড়ে উন্মাদনা থাকে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল ভক্তদের। কিছুটা জার্মান আর স্পেনের। এর বাইরে ব্যাপক হারে সব খেলার দর্শক কিন্তু সব সময় থাকে না। আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের খেলার সময় প্রেক্ষাগৃহ ফাঁকা থাকবে। কিন্তু যারা সিনে দর্শক, তারা সেটা পরে পুষিয়ে নেবে। বিশ্বকাপ প্রভাব ফেলবে, কিন্তু বড় অর্থে না।’
জীবনের প্রথম পরিচালিত ‘বসগিরি’ ছবিতে শাকিব খানের মতো জনপ্রিয় নায়ক আর বুবলীর মতো সম্ভাবনাময় নবাগত এক করে আলোচিত হন শামীম আহমেদ রনি। তিনি মনে করেন, ‘বিশ্বকাপ ফুটবলের কারণে ছবি দেখার দর্শক কিছুটা হলে কমবে। তবে ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলতে পারবে না। ছবি যদি ভালো হয়, দর্শক প্রেক্ষাগৃহে ছুটবেই।’
এবার ঈদে ভারতের কলকাতায় মুক্তি পাবে বাংলাদেশের নায়ক আমান রেজা ছবি ‘সুলতান দ্য সেভিয়ার’। তিনি মোটেও মানতে রাজি নন, ফুটবল বিশ্বকাপ প্রেক্ষাগৃহে দর্শকে ভাগ বসাবে। তিনি বলেন, ‘ছবিপ্রেমী দর্শক ঈদের ছুটিতে প্রেক্ষাগৃহে ছুটবেই। কারণ, ঈদ উৎসবে ছবি দেখার আনন্দ অন্য রকম। এই বিষয় আমার নিজের মধ্যেও কাজ করে।’
দেশের চলচ্চিত্রে অসংখ্য ছবির নায়ক অমিত হাসান মনে করেন, বিশ্বকাপ ফুটবলে ঈদে মুক্তি পাওয়া ছবির প্রতি দর্শকের আগ্রহ কম থাকবে। কারণ হিসেবে এই নায়ক বলেন, ‘সময়ের অভাবে দর্শকদের কেউ কেউ যেকোনো একটিকে বেছে নেবেন। তবে এটাও ঠিক যে ছবি ভালো হলে দর্শক প্রেক্ষাগৃহে ঢুঁ মারবেই। সে ক্ষেত্রে রিপিট অডিয়েন্স পাওয়ার সম্ভাবনা কম।’
চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সভাপতি ও মধুমিতা মুভিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ বলেন, ‘চলচ্চিত্রের দর্শক যাঁরা, তাঁরা চলচ্চিত্রই দেখবেন। তবে এটা ঠিক, ফুটবল বিশ্বকাপ নিয়ে বাংলাদেশে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের উন্মাদনা ব্যাপক। সন্ধ্যায় খেলা হওয়ার কারণে দর্শক কিছুটা কমবে। তবে আমি মনে করি, ছবি যদি ছবির মতো হয়, তাহলে দর্শক একবারের জন্য হলেও প্রেক্ষাগৃহে ঢুকবেন। আর দুর্বল হলে মুখে মুখে মার্কেটিং যেটা হয়, তা হবে না।’